ডেইরী খামার কাহিনী - First Mordern Bangla Agro Based Blog

Breaking

Friday, March 2, 2018

ডেইরী খামার কাহিনী

 ডেইরী খামার কাহিনীঃ

কম্প্রোমাইজ vs নো-কম্প্রোমাইজ


মিঃ ‘বাস্তব’ ও মিঃ ‘স্বপ্ন’ দুই বন্ধু (কাল্পনিক)। তারা দুজনেই ভাল আয় করেন। ছাত্রজীবনে দুজনেই ভাল ছাত্র ছিলেন, বিপ্লবী ছিলেন- সুযোগ পেলে দুনিয়াটাকে বদলে দেবেন- এরকম সাহসী ও মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন। যাই হোক ক্যারিয়ারে এসে তেমন কিছুই করা হয়নি- সারাদিন টাকার পেছনে ছোটেন। তো তারা একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন ডেইরি খামার করবেন। শুরু করলেন প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের কাজ। ফেসবুকে সব পেইজ অার গ্রুপে এড হলেন, বেশকিছু বইপত্র কিনলেন, ইন্টারনেট চষে ফেললেন, বেশকিছু খামার পরিদর্শন করে ফেললেন। এবার দুজনেই তাদের গ্রামের বাড়িতে খামার শুরু করলেন। চলুন তাদের গল্পটি শুনিঃ-

(ক) গরু কেনাঃ

মিঃ বাস্তবঃ-
ইনি হিসাব করে দেখলেন গরু কমপক্ষে ১৫ লিঃ দুধ না দিলে লাভ তো দুরের কথা, খামার Break-Even এই আসবে না। আবার ২ মাস পর থেকে দুধ কমতে থাকবে। তাই তিনি সারা দেশ ঘুরে কিছু ২০ লিটারের গাভী কিনলেন বকনা বাছুর সহ, কিছু কিনলেন বড়সড় ৫ মাসের গাভীন, কিছু কিনলেন ১২-১৪ মাসের বকনা। বাহ সুন্দর প্ল্যান! গাভীর দুধ কমতেই গাভীনগুলো বাচ্চা দিবে, ততদিনে যদি বকনাগুলো গাভীন করা যায় তো কেল্লা ফতে! প্রথম ধাক্কাটা খেলেন গাভীগুলো নিয়ে। নিজের চোখে দেখে ২০ লিটারের গরুগুলো কিনলেন- কিন্তু তার খামারে এসে কোনটাই ২০ লিঃ দিচ্ছে না- দুধ কমে গেছে। যাইহোক নতুন জায়গা ,খাদ্য পরিবর্তন, নতুন রাখাল, নতুন উদ্যোক্তা ইত্যাদি ইত্যাদি বলে মনকে প্রবোধ দিলেন। পরের বিয়ানে ঠিক হয়ে যাবে বলে আশায় বুক বাধলেন। কিছুদিন পর গাভীনগুলো বাচ্চা দিল। দুধ কম-বাচ্চাগুলোও তেমন একটা ভাল না। দুধের খামার অথচ দুধ উৎপাদন অাশার চেয়ে কম। আবার দুধের দামও কম- ক্ষোভের সীমা নেই।

মিঃ স্বপ্নঃ-
ইনি শুরু থেকেই ভাবছিলেন ইনব্রিডিং অার ক্রসব্রিডিং নিয়ে। দেশে যে গাভীগুলো কিনতে পাওয়া যায়- তার কোনটিরই কোন রেকর্ড নেই- শুধু চোখের সামনে যা দেখছেন তাই। সরকারী, ব্র্যাক, মিল্কভিটার সিমেন গুলোই বছরের পর বছর যথেচ্ছা ব্যবহৃত হয়ে দেশের এই বিপুল সংখ্যক ক্রসব্রীড (জেবু-টরাইন) গরু তৈরি হয়েছে। তিনি ভেবে দেখলেন দেশের যেখান থেকেই গাভী সংগ্রহ করেন না কেন তা ইনব্রেড হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ, টরাইন পার্সেন্টেজ এসেছে নিম্নমানের টরাইন (যেমন হলস্টিন) থেকে। অার দুধ একটু বেশি হলে সেটার টরাইন পার্সেন্টেজ যে কত বেশি- কেবল আল্লাহ জানেন। বাজারের দুধের দামের উপর তার হাত নেই। কিন্তু গরুগুলো তো তার হাতে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন- না, কেনা গরুতে খামার করব না- গরু বানাতে হবে। হিসাব করে দেখলেন ভাল মানের জেবু (যেমন শাহীওয়াল) কিনে তাতে সীমেন দিলে এক বছরের মাঝে বাচ্চা পাব। বকনা বাচ্চা দেড় বছর বয়সে গর্ভবতী হলে আরও এক বছরে বাচ্চা আসবে। অতএব গরুর খামার যদি করতেই হয় তাহলে সাড়ে তিন বছর (কপাল ভাল হলে তিন বছর) কষ্ট করে গরু তৈরি করে তবেই গরুর খামার করব। যেই চিন্তা সেই কাজ। অনেক জায়গা ঘুরে পেয়ে গেলেন কিছু শাহীওয়াল ক্রস। ভাল শাহীওয়াল ক্রস কম পাওয়া যায় বিধায় বেশকিছু দেশীয় ননডেস্ক্রিপ্ট গাভীতে দিলেন ১০০% শাহীওয়ালের সীমেন। তার খামারে এখন অনেক গরু কিন্তু দুধ খুবই কম। লোকে বলে পাগল নাকি লোকটা। এভাবে তিন চার বছর ভর্তুকি দিয়ে কেউ খামার করে নাকি!!

(খ) সিমেন দেয়াঃ

মিঃ বাস্তব তার গরুগুলোকে দিলেন ১০০% সিমেন। তার বিশ্বাস পরবর্তী প্রজন্মে হলস্টিনের পার্সেন্টেজ বাড়লে দুধও বাড়বে। অার রোগ বালাইয়ের কথা যেটা লোকে বলে সেটার জন্য ঔষধ আছে, ডাক্তার অাছে। দরকার হলে একজন পার্মানেন্ট ভেট পার্টটাইম/ফুলটাইম নিয়োগ দিয়ে দিবেন।

(পর্যবেক্ষণঃ বাস্তব সাহেবের গরুগুলোর যেহেতু কোন রেকর্ড নেই তাই তার পার্সেন্টেজ কেউ বলতে পারবে না। আর দেশের যেহেতু গুটিকয়েক ৫০%-১০০% বুলের সিমেনই যথেচ্ছা ব্যবহৃত হয় তাই ইনব্রেড হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। অতএব এই গরুগুলোতে ১০০% সিমেন দেয়ার কারনে পরবর্তী প্রজন্মে নিশ্চয়ই হলস্টিন পার্সেন্টেজ অনেক বেড়ে যাবে। সেই সাথে বাড়বে রোগবালাই, হীট স্ট্রেস, প্রজনন সমস্যা। ২/৩ টি ল্যাকটেশনের বেশি এসব গরুতে আশা করা বোকামী।)

মিঃ স্বপ্ন তার শাহীওয়ালে দিতে চান ১০০% হলস্টিন সিমেন। তাতে যে বাচ্চা আসবে তাতে জেবু ৫০% আর টরাইন ৫০% হবে। জেবুর শক্তি ও সহিষ্ণুতা অার টরাইনের উৎপাদন বৈশিষ্টের এই বাচ্চাগুলো হবে অাদর্শ ক্রসব্রীড। এই বাচ্চাগুলো দিয়েই তাকে লাভবান হতে হবে- সাড়ে তিন বছরের ভর্তুকি সব তুলে আনতে হবে। অতএব তার হলস্টিন ৫০% হতে হবে সর্বোচ্চ ভাল মানের হলস্টিন বুলের। তিনি ইন্টারনেটে অনেক ঘাটাঘাটি করে EPD, TPI বিশ্লেষণ করে দেখলেন যে সবচেয়ে ভাল সিমেন ব্যবহার করতে পারলে এই (৫০%-৫০%) প্রজন্মেই ৪০ লিটার দুধ তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব। বাস্তবে যদি ২৫ লিটারও টেকে খারাপ কি? দুধের কেজি ৪০ টাকা হলেও খামার টেকানো সম্ভব। ভবিষ্যতে এই (৫০%-৫০%) প্রজন্মে তিনি ৭৫% সিমেন দিয়ে (৩৭.৫%-৬২.৫%) প্রজন্ম তৈরি করবেন যা হবে সবচেয়ে ভাল গরু। এখানেও দুশ্চিন্তা- ভাল মানের ৭৫% তিনি পাবেন তো?

কিন্তু হায়! দেশীয় কোন ১০০% সিমেনই এই নিশ্চয়তা দেয় না। আমেরিকান ডেইরী লিঃ কিছুটা আশা দেখালেও তারা তাদের বুলের তথ্য প্রকাশে উদাসীন। দেশের চিন্তা বাদ দিয়ে তিনি এবার খুঁজলেন বিদেশী সিমেন। তিনি জানেন বিদেশী সিমেন আনার নিয়ম নেই। কিন্তু বিদ্রোহ তো অার নিয়ম মেনে হয় না ! নিয়ম তৈরি হয় মানুষের কল্যানের জন্য। কিন্তু নিয়ম যখন অকল্যান বয়ে আনে- তা ভাংতে হয় বইকি!! ACI এর কল্যানে কিছু সিমেন পেলেন Semex আর Accelerated Genetics এর. এখানেও স্বপ্নভঙ্গ- এই সিমেনগুলো ১০ বছরের পুরোনো জেনেটিক্স আর নিজ দেশে inactive. এগুলোর TPI 1400-1800. কিন্তু বর্তমানে তো 2700-2800 TPI এর বুলও আছে। কি আর করা- নাই মামার চেয়ে কানা মামাও ভাল। মনে মনে খোঁজেন ভাল সিমেন- কিন্তু পান না। একবার শুনলেন কারা যেন ইন্ডিয়া থেকে ব্যক্তি উদ্দোগে ABS Global এর ভাল ভাল সিমেন আনছেন- এমনকি Sexed সিমেনও। কিন্তু অনেক খোজাখুজি করেও অথেনটিক কাউকে পেলেন না। কি আর করা তিনি তার কিছু গরুতে দিলেন ACI Imported সিমেন আর কিছু গরুতে দিলেন ADL এর ১০০% সিমেন। সাথে রাখলেন রেকর্ড। তার গরুগুলো এখন গাভীন। তিনি মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্য স্বপ্ন দেখেন কেউ তাকে বিশ্বের সবচেয়ে ভাল TOP TPI বুলগুলোর সিমেন গিফট করেছে। কিন্তু ঘুম ভাংলে দেখেন তেমন ত্রাতার আবির্ভাব এই ধরাধামে এখনো ঘটে নাই।

(গ) গরুর খাবারঃ

মিঃ বাস্তব গরুগুলোকে ঘাস-সাইলেজ দেন না। তিনি দাম দিয়ে খড় কিনেন। ইদানিং চিন্তা করছেন তুলা খাওয়াবেন। তিনি গরুকে প্রচুর ভূষি আর দামী ফীড খাওয়ান। ঘাস না দিয়েও ফীড বেশি দিলে ভাল দুধ আসে এটা উনি পরীক্ষা করে দেখেছেন। সমস্যা ফেস করে করে উনি এখন মোটামুটি এক্সপার্ট।

মিঃ স্বপ্ন এর যতটুকু ঘাস করার জমি আছে তা তার গরুগুলোর জন্য যথেষ্ঠ নয়। তারপরেও তিনি উঁচু জমিগুলোতে নেপিয়ার আর নিচু জমিতে জার্মান ঘাস লাগিয়েছেন। পাশেই কিছু জমি ভাড়া নিয়েছেন ভুট্টা চাষ করছেন মিল্কিং স্টেজে কেটে সাইলেজ করার জন্য। তিনি সাইলেজ কি মাটির গর্তে না সাইলো পিটে (হাউসে) না ড্রামে না মোটা পলিব্যাগে করবেন তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দে আছেন। তবে যেটাতেই করেন ঘাস কমে গেলে তার সাইলেজ লাগবেই। তার কাছাকাছি কোন অঞ্চলে ভুট্টা চাষ হয়- তিনি সেই খোজ-খবর এখন নিচ্ছেন। মিল্কিং স্টেজে যদি ক্ষেত ধরে ভুট্টা গাছ কিনে ফেলে ট্রাকে করে খামারে নিয়ে এসে সাইলেজ করেন তবে খরচ-পাতি কেমন হতে পারে তার হিসেব নিকেশ করছেন। স্বপ্ন সাহেব নিজ হাতে বিভিন্ন খাদ্য উপাদান কিনে মিক্স করে ফীড তৈরি করেন। তিনি বাজারের ফীডে ভরশা করতে পারেন না। তাই বাজারদর অনুযায়ী তিনি উপাদান বাছাই করেন। তবে আমিষ-শর্করা-স্নেহ-অাঁশ কোনটার যাতে ঘাটতি না পরে সেদিকে খেয়াল রাখেন। তিনি দৈহিক ওজন ও দুধের পরিমান নির্ভর ফরমুলার বাহিরে এক দানা খাবারও বেশি দেন না।

পর্যবেক্ষণঃ (অামজনতা ভার্সন)

১. বাস্তব সাহেবই ঠিক আছেন। সংগ্রাম করে আগাচ্ছেন। এভাবেই আগাতে হয়। বাস্তব সাহেব শুরু থেকেই ভাল দুধ পাচ্ছেন। রানিং ব্যবসা। আর যে গরুতে বেশি সমস্যা হয় কোনো রকম গাভীন করে দালাল ধরে ভাল নতুন পার্টির কাছে বেচে দিলেই হল। একটি বেচে দুটি কিনবেন। দুধটা ভাল দেখে কিনতে পারলে, পুরা দুধটা বেচার পর, গাভীতে সমস্যা হলে নতুন পার্টি দেখে বেচে দিলে ভাল দাম পাওয়া যায়। আর বাছুরটা তো পুরাই লাভ।

২. স্বপ্ন সাহেব বেশী বোঝেন। এইভাবে ব্যবসা হয় নাকি? তার গরু কবে বাচ্চা দিবে? তার মধ্যে কয়টি বকনা হবে? সেই বকনা কবে দুধ দিবে? তারপর লাভ হবে!!! ব্যবসা অত সোজা নাকি? আর ঘাস ঘাস করে কি লাভ? চারটা খড় দিবেন, ভাল ফিড দিবেন, খুদ- ভুসি দিবেন। ফিড বেশি দিলে দুধ বাড়ে - পরীক্ষিত।

আমার পর্যবেক্ষণঃ

(ক) ভাই, আপনি বাস্তব সাহেবের মত হতে চান হন না!!! কিন্তু খেয়াল করেছেন কি?---

১. আপনি সারাক্ষন দুধের দাম পেলাম না বলে কান্নাকাটি করেন। কিভাবে ৫ টাকা বেশি পাওয়া যায় তা নিয়ে মাথা ঘামান। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা হল--- দাম আপনার হাতে নয়। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা-যোগান-পন্যের শেল্ফ লাইফ- কাচামাল না ফিনিশড প্রোডাক্ট ইত্যাদির উপর পন্যের দাম নির্ভর করে। কম খরচে অধিক দুধ পেলে দাম নিয়ে আপনাকে মাথা খুটতে হত না।

২. দেশের প্রচলিত এসব ইনব্রেড হাই-পারসেন্টেজ গাভী সংগ্রহ করে আপনি কোন ফরমুলায় পারসেন্টেজ কমিয়ে পারফরমেন্স বাড়াবেন? - প্রশ্ন রইল।

৩. অার নতুন পার্টিদের রিজেক্ট গরু অার কত কাল গছাবেন? নতুনরা তো চিরকাল বোকা থাকবে না - তারা সচেতন হল বলে!
( ঐ নতুণের কেতন উড়ে, অাসছে ভয়ঙ্কর-
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!)

(খ) স্বপ্ন সাহেব হয়তো এখন লস করছেন।( তিনি নিজে মনে করেন- তিনি বিনিয়োগ করছেন। গাছ লাগানোর মত।) কিন্তু সাড়ে তিন বছর পর তার সাথে দৌড়ে আপনি পারবেন না। --- চ্যালেঞ্জ--। আপনি হয়ত 'Realist', কিন্তু তিনি 'Visionary' - দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।

অামার পরামর্শঃ

নিঃসঙ্গ শেরপা হওয়াটা কঠিন। একলা চলাটা বেদনাদায়ক। কিন্তু " দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ"

চলুন না ভাই মিঃ স্বপ্নের পথে চলে ডেইরি সেকটরের হয়ে যাওয়া ভুলগুল শুধরাই।
আর যারা মিঃ বাস্তবের পথে অলরেডী চলছি তারাও ভুল স্বীকার করে সঠিক পথে আসার প্রক্রিয়াটি শুরু করি।
(দিন বদলের দিন এসেছে- কান পেতে ঐ শোনো)
A good beginning is half done.

অতএব অপশন তিনটাঃ
১. কম্প্রোমাইজ।
২. নো- কম্প্রোমাইজ।
৩. আপাতত কম্প্রোমাইজ হলেও ভবিষ্যৎটা যেন নো- কম্প্রোমাইজ হয়! (হিঃ হিঃ!!!)

তো, কোনটা করবেন???


লেখকঃ খালিদ রবিন

No comments:

Post a Comment