ভুট্টা কাহিনীঃ
উপক্রমণিকাঃভুট্টাতে কত কি পুষ্টিগুণ আছে আর তার জাত-প্রজাতি কি কি তা বলাটা আজকে আমার উদ্দেশ্য নয়- আপনারা Corn বা Maize লিখে নেটে সার্চ দিলেই ভুট্টার গুণাগুণ পেয়ে যাবেন। আজকে আমি ভুট্টার একটি অন্য সম্ভাবনার কথা বলব।
মূলকথাঃ
গরুর দানাদার খাদ্য বলতে আমাদের দেশে আমরা গমের ভুসি, চাউলের কুঁড়া ও খুদ, বিভিন্ন প্রকার ডালের (যেমন মসুর, মুগ, খেসারি, মাসকলাই, ডাবরি, এংকর বুট ইত্যাদি) খোসা, ভুষি, কুনি বা খুদ, বিভিন্ন প্রকার তৈলবীজের (যেমন তিল সয়াবিন, সরিষা, কালিজিরা, নারকেল) খৈল বা কেক, চিটাগুড় আর ভুট্টাকেই বুঝি।
তো, ভাই, খেয়াল করে
দেখেছেন কি ভুট্টা বাদে বাকি সবগুলোই কিন্তু মানুষের খাবারের উপজাত
(Byproduct)-- কেবল ভুট্টাই সরাসরি গরুর খাবার (পপকর্ন কালচারের কথা বাদ
দিলে)।ভাই, এদেশে মানুষ আছে প্রায় আঠার কোটি, আর গরু আছে প্রায় তিন কোটি। মানুষ প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ খাবার দুটোই খায়- আর গরু শুধু উদ্ভিজ্জ খাবার খায়।
ভাই আলোচনার সুবিধার্থে ধরে নেই-- মানুষ যে পরিমাণ খাবার খায় তার অর্ধেক উদ্ভিজ্জ এবং মানুষের এই উদ্ভিজ্জ খাবার তৈরি করতে তিন ভাগের একভাগ উপজাত (কুড়া, ভুসি, খুদ) বের হয়। অর্থাৎ মানুষের মোট খাদ্যের (১/২x১/৩) ছয় ভাগের একভাগ উপজাত বের হয়। মানুষ প্রতিদিন গড়ে ২ কেজি খাবার খেলে ১৮ কোটি মানুষের প্রতিদিনের ৩৬ কোটি কেজি খাবারের জন্য উপজাত বের হয় ৬ কোটি কেজি ( ৬ ভাগের ১ ভাগ)। তো ৩ কোটি গরুর প্রতিটির ভাগে পড়ে গড়ে ২ কেজি উপজাত। এখানেও ভাগ বসায় বিশাল পোল্ট্রি শিল্প, মাছ, ছাগল,ভেড়া, মহিষ ইত্যাদি। তার মানে গরুর ভাগে এক-দেড় কেজি পড়ে কিনা সন্দেহ। অথচ গরুর দানাখাদ্য দরকার ২-১০ কেজি (গড়ে ৫ কেজি)। এজন্যই এসব খাবারের এত দাম। দেখা যায় গমের চেয়ে গমের ভুসির বা ডালের চেয়ে ডালের খোসার দাম বেশি (তুলনামূলক ভাবে)।
খড়ের ক্ষেত্রে একই কথা খাটে- কারন এটিও ধানের উপজাত। অর্থনীতির সহজ ফর্মুলা হল- চাহিদা (demand) বাড়লে যোগান (supply) বাড়তে হবে; নয়তো দাম বেড়ে যাবে। তো ভাই এসব উপজাত খাদ্যের যোগান বাড়ানো তো সম্ভব নয়- কারণ বাজারে উপজাতের পরিমাণ মানুষের খাদ্যের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল, গরুর চাহিদার উপর নির্ভরশীল নয়। তাই যে যত কথাই বলুক, যেহেতু দেশে গরুর সংখ্যা বাড়ছে এবং দেশীয় ছোট গরু বড় ক্রস গরু দ্বারা প্রতিস্থাপিত (replaced) হচ্ছে-- অতএব এসব উপজাত খাবারের দাম বাড়তেই থাকবে এবং কমার কোন পথ নেই। আর সরকারের পক্ষেও দাম নিয়ন্ত্রণের কোন ফর্মুলা নেই। কারন সরকার হস্তক্ষেপ করলেও যোগান তো আর বাড়াতে পারবে না।
তাহলে উপায়?
ভাই উপায় হল- এমন খাদ্য লাগবে যেটি শুধু গরুর জন্যই চাষ করা হয়- যেমন ভুট্টা। গরুর চাহিদা বাড়লে ভুট্টার চাষ বাড়বে। বিদেশ থেকেও মনুষ্য খাদ্যের চেয়ে কম মূল্যে তা আমদানী করা যাবে। গো-খাদ্যে তাই ভুট্টার ব্যাপক প্রচলন সময়ের দাবি।
ভুট্টার সুবিধা প্রধানত দুইটি জায়গায়:
একঃ ভুট্টার দাম মৌসুমে ১৪/১৫ টাকা কেজি থাকে। তাই এটি বর্তমানে বাজার অনুযায়ী যথেষ্ট সস্তা। অন্য কোন উপজাত খাবারই আপনি দুই মাসের বেশি সংরক্ষণ করতে পারবেন না। কিন্তু ভুট্টা শুকনা দেখে কিনতে পারলে সারা বছরের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। শুধু দুই মাস পর পর একটা রোদ দিবেন যাতে অদৃশ্য ফাংগাস তৈরি না হয়। পুরোনো হয়ে গেলে সাথে টক্সিন বাইন্ডার ব্যবহার করতে হবে।
দুইঃ ভুট্টার ব্যবহার সম্ভব সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেলে অন্যান্য উপজাত খাবারের উপর চাপ কমবে- তাই দাম কমতে শুরু করবে এবং হাতের নাগালে আসবে।
তাহলে করণীয়:
১. ভুট্টার ব্যবহার বাড়াতে হবে। সুজির মত গুড়া করে ভুট্টা খাওয়ানো সবচেয়ে উত্তম। সিদ্ধ, ভাঙ্গা, মিহি পাউডার এসবে না যাওয়াই ভাল।
২. অনেকেরই অভিযোগ- নতুন করে ভুট্টা শুরু করলে গরুর পেট খারাপ হয়।
ভাই এটারও ফর্মুলা আছে-
গরুকে আপনি যা খাওয়ান তা মূলত খাওয়ান রুমেনের ব্যাকটেরিয়াকে (Rumen microflora). কুড়া-ভুসির জন্য একধরণের ব্যাকটেরিয়া আর ভুট্টার জন্য আরেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। রুমেনে সবধরণের ব্যাকটেরিয়াই আছে- যাদের কাজ বেশি তারা সংখ্যায় বাড়ে। তো কুড়া-ভুসি খাওয়া গরুকে ভুট্টা খাওয়াতে চাইলে ধীরে ধীরে শুরু করতে হবে- যাতে ভুট্টার ব্যাকটেরিয়া বংশবিস্তার করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। আপনি একটি গরুকে পাঁচ কেজি ভুট্টা খাওয়াতে চাইলে ১০০ গ্রাম থেকে শুরু করুন- তারপর প্রতিদিন ৫০-১০০ গ্রাম করে বাড়ান- দুই মাস সময় নিয়ে ৪/৫ কেজিতে উন্নীত করুন। বাছুরগুলোকে ছোটবেলা থেকেই ভুট্টায় অভ্যস্ত করুন।
৩. ভুট্টা সর্বোচ্চ কতটুকু খাওয়ানো যায়?
---এর উত্তর হল- আপনি আপনার গরুকে যতটুকু অভ্যস্ত করাতে পারেন- ততটুকুই খাওয়ানো যায়। শুনেছি কেউ কেউ মোট দানাখাদ্যের দুই তৃতীয়াংশ পর্যন্ত ভুট্টা দেন। যতটুকু সম্ভব ভুট্টা দিয়ে বাকিটা উপজাত খাবার দিতে হবে। উপজাত খাবার একেবারে বাদ- একথা কিন্তুু বলছি না।
★★★★
ভাই, বিশেষজ্ঞরা তো ৮-১০ টা উপাদান দিয়ে রেশনের ফর্মুলা দেন। আর এসব ফর্মুলা যখন প্রণয়ন করা হয়েছিল তখন উপজাত খাবারের দাম কমই ছিল। তারপর থেকে শুধু copy-paste চলছে। কিন্তু বর্তমান বাজারে যে আগুন লেগেছে তার আঁচ তো বিশেষজ্ঞের পকেট পর্যন্ত পৌছায় না। তাই cost-benefit analysis অর্থাৎ মূল্য-ফলাফল বিশ্লেষণ করলে অনেক ফর্মুলাই অচল।
"আধাসের পানি- একমুঠো গুড়- তিন আংগুলের এক চিমটি লবন- এই দিয়ে স্যালাইন" ---এই ফর্মুলা যখন প্রণয়ন হয়েছিল তখন গুড়ের দাম চিনির দামের এক তৃতীয়াংশ ছিল। আজ গুড়ের দাম চিনির দামের দ্বিগুণ এবং বাজারের প্রায় সব গুড়েই ভেজাল। তাই এক মুঠো গুড় না বলে চিনি বলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা কবে আপগ্রেড হবেন- সেটা তাদের ব্যপার- আমরা খামারীদের আপগ্রেড না হলে পথে বসতে হবে। অতএব ভাই, এমন জিনিস নিয়ে মাথা ঘামান যা আমাদের হাতে আছে- আমরা চাইলেই ভুট্টার ব্যবহার বাড়াতে পারি। বাজারের উপজাত খাবারের দাম কমে না কেন-- সরকার কিছু করে না কেন-- এসব বলে কান্নাকাটি করে কোন লাভ আছে কি???
যার গরু ৩০ লিটার দুধ দেয় তার ৫০ টাকা কেজি দানা খাদ্য খাওয়ালেও সমস্যা নেই। কিন্তু কম দুধ আর নতুন খামারীদের তো সেই সুযোগ নেই। উপজাত খাদ্যের দামের দৌরাত্মে আজ অনেক খামার বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তাই দুধ ভাল পেলেও 'একলা চল' নীতি পরিহার করতে হবে- সমগ্র ইন্ডাস্ট্রির কথা ভাবতে হবে। কমমূল্যে সর্বোচ্চ পুষ্টির পথে যেতে হবে। সবাই মিলে ভুট্টার ব্যবহার সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেলেই কেবল খাদ্যের বাজারের আগুন নিভবে। এই ফর্মুলার বাইরে খাদ্যের বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রনের অন্য কোন ফর্মুলা নেই। যদি ভাই, অন্য কোন ফর্মুলা আপনার কাছে থেকে থাকে- তাহলে শেয়ার করুন- জাতি আপনাকেই খুঁজছে।
No comments:
Post a Comment