“ইনব্রিডিং কাহিনী”
ইনব্রিডিং কি, কিভাবে ক্ষতি হয় আর ক্ষতি ঠেকানোর উপায় কি?
আসুন কয়েকটি ভাগে বোঝার চেষ্টা করি।
১. ইনব্রিডিং কি?
ইনব্রিডিং জেনেটিক্স বা কৌলিতত্ত্বের অত্যন্ত জটিল একটি চ্যাপ্টার। কিন্তু আমরা আজকে জটিলতায় না গিয়ে সহজে বোঝার চেষ্টা করব। ইনব্রিডিং হল শরীয়তের নিয়মের বাইরে বিয়ে। হ্যা দাদা, নানা, বাবা, ভাই প্রভৃতি নিকট আত্নীয়ের সাথে গাভীর বিয়ে দিলেই ইনব্রিডিং।
২. সমস্যা কি এবং কেন?
প্রত্যেক প্রাণীর সকল বৈশিষ্ট্য তার জীন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন কতটুকু দুধ দিবে, বাটের সাইজ কি হবে, গায়ের রঙ কি হবে, দুগ্ধ শিরা কেমন হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। একটি বাছুর তার নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জীন অর্ধেক পায় বাপ থেকে আর অর্ধেক পায় মা থেকে এবং এ দুটি জীনের যেটি শক্তিশালী সেটির বৈশিষ্টই প্রকাশ পায়। প্রত্যেক প্রাণীরই জীন পরিবর্তিত হয় (মিউটেশন)। পরিবর্তিত হয়ে যেমন ভাল হতে পারে আবার খারাপও হতে পারে। ধরুন কোন একটি বংশে দুগ্ধশিরা ভাল হওয়ার জীন পরিবর্তিত হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে- এটিকে আমরা ধরে নেই নষ্ট বাতি হিসেবে। তাহলে এই বংশের কন্যার যদি একই বংশে বিয়ে হয় তাহলে বাচ্চা বাবা ও মা উভয়ের কাছ থেকে একটি করে নষ্ট বাতি পেল। অর্থাৎ ঘরে আলো জ্বলবে না। অর্থাৎ দুগ্ধশিরা ভাল হবে না। কিন্তু কন্যাটির যদি অন্য বংশে বিয়ে হত তাহলে বাচ্চা মায়ের কাছ থেকে নষ্ট বাতি পেলেও বাবার কাছ থেকে ভাল বাতি পাচ্ছে। ফলে ঘর আলোকিত থাকছে। অর্থাৎ দুগ্ধশিরা ভাল থাকছে। অর্থাৎ কোন বংশের জীনগত ত্রুটিসমূহ অন্য বংশের সাথে মেশানোর ফলে এসব ত্রুটিজাত অক্ষমতা এড়ানো যায়। একই বংশে হলে এসব অক্ষমতা (যাকে রিসেসিভ ট্রেইট বলে) এড়ানো যায় না।
৩. সমাধানের উপায় :
সমাধান তো খুবই সহজ। ইনব্রিডিং না করালেই হল। কিন্তু ভাই সমস্যা হল আমার বাপ বুড়া আর দাদা-নানা তো কবরে। কিন্তু বকনার বাবা, দাদা, নানা, ভাই সবাই ইয়ং এন্ড হ্যান্ডসাম, কেউ কাউকে চেনে না। তাই ইনব্রিডিং ঠেকানোর উপায় নেই। কারণ :
ক) আমাদের দেশে ডেইরি শিল্প এখনো কোন বৃহৎ শিল্প নয়, বরং কুটির শিল্প। একটি খামারে প্রতিটি গাভীর সঠিক প্রজননের ইতিহাস সংরক্ষন করা বেশিরভাগ খামারীর পক্ষে সম্ভব নয়।
খ) কুমিল্লার গরু ঢাকায়, পাবনার গরু নারায়নগঞ্জে, ময়মনসিংহের গরু যশোরে যাচ্ছে এবং যাবে। বহু খামারী আছেন বকনা সংগ্রহ করে বীজ দেন- গাভীন হলে বা বাচ্চা দিলে বিক্রয় করে দেন। অতএব আমি যে গাভীটি কিনে আনছি তার ইতিহাস জানা সম্ভব নয়। বর্তমানে দেশে যত গাভী আছে তার ৯৯.৯৯% এর প্রজনন ইতিহাস কেউ জানে না।
অতএব সচেতনতা বৃদ্ধি, ইতিহাস সংরক্ষনের উপর গুরুত্ব দেয়া প্রভৃতি সাজেশন দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে কি?
৪. তাহলে শেষরক্ষার উপায় :
হ্যা ভাই। উপায় একটাই এবং তা খামারীদের হাতে নয়। সরকারের হাতে। একটি ব্রিডিং বুল দামী কিন্তু ডেইরি সেক্টরের তুলনায় নগন্য। একটি বুল হতে বীজ সংগ্রহ করে তা বকনা বা গাভীকে দিলে যদি বকনা বাচ্চা জন্ম নেয় তবে তা হিটে আসতে মোটামোটি সর্বনিম্ন ২৪ (১০+১৪) মাস (বা ২২ মাসও হতে পারে) সময় লাগে। যেহেতু সকল ব্রিডিং বুলকে (সব কোম্পানীর) সরকারী রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়, অতএব রেজিস্ট্রেশন দিতে হবে ২৪ মাসের জন্য। অর্থাৎ একটি বুল দশ বছর ধরে সিমেন দিয়ে যাবে আর ইনব্রিডিং হবে না- এটা আশা করা যায় না। অতএব বুল সিমেন দিবে দুই বছর। এরপর সে বাদ। এরপর অন্য বংশের নতুন বুল আসবে। ফলে ইনব্রিডিং এড়ানো যাবে। অর্থাৎ সরকার উদ্যোগী হলেই ইনব্রিডিং এড়ানো সম্ভব। সরকারের কৌলিতত্ত্ববিদগণ এসব তথ্য ভাল করেই জানেন। এখন খামারীদের জোরালো দাবি উপস্হাপন করতে হবে। ব্র্যাক, মিল্কভিটা, সরকারী সিমেন বহুবছর ধরে যথেচ্ছা ব্যবহার হয়েছে। এসিআই আর আমেরিকান ডেইরীর সিমেন হয়ত আরো কিছুদিন নিরাপদ থাকবে। কিন্তু তারপর? অতএব সমাধান একটাই কোন সিমেন দুই বছরের অধিক মার্কেটে থাকতে পারবে না।
("নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।"
জুতা আবিষ্কার- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বি: দ্র: তাহলে যতক্ষণ না বিড়ালের গলায় ঘন্টা পড়ানো হচ্ছে- আমরা কি করব?
হ্যা করণীয় দুটি:
১. যেখানেই শুনবেন নতুন বুলের সিমেন আছে সেটা ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে।
২. জিরো থেকে শুরু করতে পারেন। প্রচলিত বীজ গুলোই লোকাল গাভীতে দিয়ে নিজেরা জাত উন্নয়ন করে নিতে পারেন।
*********************************
ভাই, সরকার কবে সচেতন হবে আর নতুন বুল আনবে সে আশায় বসে থাকলে আমাদের সফল খামার করা শিকেয় উঠবে। এ মুহূর্তে আমাদের সামনে দুটি কাজ করার আছে।
১. যে ক্রস গাভীগুলো আমাদের কাছে আছে আমরা ধরে নেব এগুলো ব্র্যাক বা সরকারী বীজ দিয়ে তৈরী করা। অতএব ইনব্রিডিং ঠেকাতে হলে কোন ভাবেই এগুলোতে সরকারী বা ব্র্যাকের বীজ দেয়া যাবে না। দিতে হবে আমেরিকান ডেইরী ও এসিআই বা সিমেক্সের বীজ এবং অবশ্যই রেকর্ড রাখতে হবে। আগের রেকর্ড নাই কিন্তু হালের রেকর্ড রাখা জরুরী।
২. আমেরিকান ডেইরী ও এসিআই এর বুল সীমিত ও সহজলভ্য নয় কিন্তু সরকারী বুলের বীজ সহজলভ্য। তাই একে কাজে লাগাতে পারেন শাহীওয়াল গাভীতে। ৩য় বিয়ানের একটু বড় সাইজের শাহীওয়াল গাভীতে ১০০ % সরকারী বীজ দিলে আমরা যে বকনা পাব তা ৫০% আসবে। এই বকনাতে আবার অন্য কোন ৭৫% দিলে ৬২.৫% বকনা পাওয়া যাবে যা সম্পূর্ণ ইনব্রিডিংমুক্ত। আর আমাদের আবহাওয়াতে ৬২.৫% এর উপরে যাওয়ার কোন দরকার নেই। তাই যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যমান খামারের পাশাপাশি ২/৪/৫ টি বড় সাইজের শাহীওয়াল গাভী দিয়ে ভাল গাভী তৈরীর প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। বাচ্চা দুধ কম পেলে মিল্ক রিপ্লেসার তো আছেই।
বি:দ্র: নিজেরা ষাড় তৈরী করে ইনব্রিডিং হয়ত ঠেকানো যাবে কিন্তু কতটা ভাল হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ কেননা প্রজেনী টেস্ট সম্ভব নয়। আর বাজারে সিমেন তো আছেই- শুধু উপরের ফর্মুলাদুটি মানতে হবে আর রেকর্ড রাখতে হবে। মনে রাখবেন কেনা গাভীতে ভবিষ্যৎ নেই, ইনব্রিডিংমুক্ত গাভী নিজেরা বানাতে পারলে তবে যদি কিছু হয়। অতএব পরিকল্পনা হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি।
লেখকঃ খালিদ রবিন ।


No comments:
Post a Comment